Sunday, July 21, 2019

বিভীষনের প্রতি মেঘনাদবধ


লেখক: মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

“এতক্ষণে”– অরিন্দম কহিলা বিষাদে,

এই লাইনটিতে বলা হয়েছে, “এতহ্মণে মেঘনাদ বললো মনের দুঃখে,”

জানিনু কেমনে আসি লক্ষণ পশিল

রক্ষপুরে! এই বাক্যটিতে বলা হচ্ছে, “জানি না কিভাবে লহ্মণ রহ্মসদের পুরিতে প্রবেশ করলো!” হায়, তাত, উচিত কি তব

এ কাজ, নিকষা সতী তোমার জননী! “হায়, চাচা, উচিত কি তোমার এই কাজ করা, নিকষা তোমার সতী মা!”

সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ“ভাই তোমার রাহ্মসদের রাজা!”শূলিশম্ভুনিভ

কুম্ভকর্ণ? এখানে কুম্ভকর্ণ রাবণের মেজো ভাই। শূলিশম্ভুনিভ মানে, যার হাতে মহাদেবের মতো অগ্রভাগ বিশিষ্ট অস্ত্র? ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ী! “ভাইয়ের পুত্র মেঘনাদ বাসবকে জয় করেছে।”

নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে? এখানে মেঘনাদ বিভীষণকে আরও বলছে, “নিজের ঘরে আসার পথ, চাচা, দেখাও চোরকে?”

চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে? ‘চণ্ডাল’ – হিন্দু নিচু সম্প্রদায় আজ রাজা রাবণের বাড়িতে ঢুকেছে?”

কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরু জন তুমি

পিতৃতুল্য। “তবে তোমার তিরস্কার করি না, তুমি পিতার সমতুল্য গুরুজন।  ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে, ছেড়ে দাও দরজা, যাব অস্ত্র রাখা কহ্মে, 

পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে, লহ্মণকে যমালয়ে পাঠাবো,

লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে।” রামপুরিতে লহ্মণের প্রবেশ করাকে মেঘনাদ ‘লঙ্কার কলঙ্ক’ বলেছে। এই কলঙ্ক আজ যুদ্ধ করে দূর করবে।

উত্তরিলা বিভীষণ, “বৃথা এ সাধনা,

ধীমান্! উত্তর দিলো বিভীষণ, বৃথা এ সাধনা, বিজ্ঞ/জ্ঞানী!রাঘবদাস আমি; কী প্রকারে

তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব, রক্ষিতে

অনুরোধ?” রাম বংশের সন্তান রঘুর দাস আমি; কিভাবে তাঁর বিপহ্মে কাজ করবো, তোমার অনুরোধ রাখতে?উত্তরিলা কাতরে রাবণি;- মেঘনাদ কাতর কণ্ঠে উত্তর দিলো;-

“হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে! হে পিতার সমতুল্য, তোমার কথায় আমার মরতে ইচ্ছা করছে!

রাঘবের দাস তুমি? রঘুর দাস তুমি? কেমনে ও মুখে

আনিলে এ কথা, তাত, কহ তা দাসেরে! কিভাবে ও (রাঘবের দাস) কথা মুখে বললে, চাচা,  বলো তা আমাকে (মেঘনা নিজেকে দাস বলে অ্যাখায়িত করেছে)!স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থাণুর ললাটে; সৃষ্টিকর্তা চাঁদকে আকাশের কপালে স্থাপন করেছে;

পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি

ধূলায়? চাঁদ কি কখনো মাটিতে ধূলায় গড়াগড়ি যায়?হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে

কে তুমি? হে রাক্ষসকুলের বীর কিভাবে তুমি ভুলে গেলে তোমার পরিচয়? জনম তব কোন মহাকুলে? জন্ম গ্রহণ করেছো তুমি কোন উচ্চ বংশে?

কে বা সে অধম রাম? কে এই রাম? স্বচ্ছ সরোবরে

করে কেলি রাজহংস পঙ্কজ-কাননে; স্বচ্ছ পানির পুকুরে পদ্ম ফুলের বাগানে রাজহংস/রাজহাঁস খেলা করে;

যায় কি সে কভু, প্রভু, পঙ্কিল সলিলে,

শৈবালদলের ধাম? সে কি কখনো যায়, সৃষ্টিকর্তা, কাঁদাযুক্ত শেওলাযুকক্ত পুকুরে?

মৃগেন্দ্র কেশরী,

কবে, হে বীরকেশরী, সম্ভাষে শৃগালে

মিত্রভাবে? কেশরযুক্ত বনের রাজা সিংহ কি কখনো বন্ধু ভেবে কাছে ডাকে?অজ্ঞ দাস, বিজ্ঞতম তুমি,

অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে। আমি তো মূর্খ, তুমি তো অনেক জ্ঞানী তোমার তো কিছু অজানা নয়।

ক্ষুদ্রমতি নর, শূর, লক্ষণ; নহিলে

অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে? লক্ষণ ছোট শক্তিহীন যোদ্ধা, নাহলে কি অস্ত্রহীনের সাথে যুদ্ধ করতে চাই?

কহ, মহারথী, এ কি মহারথীপ্রথা? বলো, মহাবীর, এটা কি মহাবীরের কাজ?

নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে

এ কথা! এমন কোনো শিশু নেই লঙ্কাপুরে, যে এই কথা শুনে হাসবে না! 

ছাড়হ পথ; আসিব ফিরিয়া

এখনি! ছেড়ে দাও পথ; এখনি ফিরে আসবো!দেখিব আজি, কোন্‌ দেববলে,

বিমুখে সমরে মোরে সৌমিত্রি কুমতি! দেখবো আজ, কোন দৈবশক্তির জোরে, সুমিত্রার সন্তান আমাকে বাধা দেয়! 

দেব-দৈত্য-নর-রণে, স্বচক্ষে দেখেছ,

রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, পরাক্রম দাসের! দেততা, দৈত্যের, নরের যুদ্ধে শক্তি তুমি দেখেছো! কী দেখি

ডরিবে এ দাস হেন দুর্বল মানবে? কি দেখে ভয় পাবো আমি দুর্বল মানুষকে (লাক্ষণ)?

নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রগল্‌ভে পশিল

দম্ভী; নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে নির্ভীক চিত্তে প্রবেশ করলো দাস্তিক; আজ্ঞা কর দাসের! হুকুম করো এ দাসকে! শাস্তি নরাধমে। নরাধমের শাস্তি দেই।

তব জন্মপুরে, তাত, পদার্পন করে

বনবাসী! তোমার জন্ম ভূমিতে, চাচা, এক বানবাসীর পা পড়েছে! হে বিধাতঃ, নন্দন-কাননে

ভ্রমে দুরাচার দৈত্য? হে সৃষ্টুকর্তা তোমার স্বর্গীয় বাগানে এক দুর দেশের দৈত্য ভ্রমণ করছে? প্রফুল্ল কমলে

কীটবাস? ফুটন্ত ফুলে একটি বিষাক্ত পোকা ডুকেছে? কহ তাত, সহিব কেমনে

হেন অপমান আমি,- ভ্রাতৃ-পুত্র তব? বলো চাচা, কিভাবে সহ্য করবো আমি অপমান তোমার ভাইয়ের পত্র হয়ে?

তুমিও, হে রক্ষোমণি, সহিছ কেমনে?” তুমিও তো রাক্ষসকুলের মনি, কীভাবে সহ্য করছো?

মহামন্ত্র-বলে যথা নম্রশিরঃ ফণী, প্রবল মন্ত্রের বলে মাথা নিচু করে,

মলিনবদন লাজে, মলিন মুখে লজ্জায়, উত্তরিলা রথী

রাবণ-অনুজ, উত্তর দিল রাবণের ছোট ভাই বিভীষণ, লক্ষি রাবণ-আত্মজে; রাবণের পুত্রকে (মেঘনাদ) লক্ষ করে;

“নহি দোষী আমি, বৎস; বৃথা ভর্ৎস মোরে

তুমি! আমার কোনো দোষ নেই বৃথা তুমি আমাকে দোষারোপ করছো! নিজ কর্ম-দোষে, হায়, মজাইলা

এ কনক-লঙ্কা রাজা, মজিলা আপনি! নিজের কাজের কারণে, হায়, বিপাদ গ্রস্থ হলে এ স্বর্গ লঙ্কার রাজা (এখানে মেঘনাদকে বলা হয়েছে), বিপাদগ্রস্থ হলে আপনি!

বিরত সতত পাপে দেবকুল; সব সময় দেবকুল পাপ মুক্ত/দূরে থাকে; এবে

পাপপূর্ণ লঙ্কাপুরী; তবে লঙ্কাপুরী পাপে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে;প্রলয়ে যেমতে

বসুধা, ডুবিছে লঙ্কা এ কালসলিলে! ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে যেভাবে পৃথিবী, ডুবছে লক্ষণ যেন এক অশুভ পানিতে!

রাঘবের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী

তেঁই আমি। রাঘবের পায়ের নিচে আশ্রয় নিয়েছি সেজন্য আমি। পরদোষে কে চাহে মজিতে?” পরের কারণে (দোষে) কি চাই বিপদে পড়তে?”

রুষিলা বাসবত্রাস। রাগান্বিত হলো বাসব ভয় সৃষ্টিকারী মেঘনাদ।

গম্ভীরে যেমতি

নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি,

কহিলা বীরেন্দ্র বলী,-“ধর্মপথগামী,

হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে

তুমি; – কোন্‌ ধর্ম মতে, কহ দাসে, শুনি,

জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি,- এ সকলে দিল

জলাঞ্জলি? মেঘনাদ গম্ভীরভাবে রাতের আধারে আকাশে মেঘের আওয়াজের মত গর্জে উঠে বললো, “ধর্মের পথে তুমি রাক্ষসরাজার+অনুজ, কোন ধর্মের মতে, বলো দাসকে (মেঘনাদকে) শুনতে চাই নিজের সম্পর্ক, কুল, জাতি ত্যাগ করলে? শাস্ত্রে বলে, গুণবান্ যদি

পরজন, গুণহীন স্বজনে, তথাপি

নির্গুণ স্বজন শ্রেয়ঃ, পরঃ পরঃ সদা! পরের মানুষ কখনো স্বজন হয় না, তবে গুণবান পরের মানুষের চেয়ে আপন মানুষ ভালো, পর সব সময় পরই হয়!

এ শিক্ষা, হে রক্ষোবর, কোথায় শিখিলে? রাহ্মসকুলের কর্তা আত্মীয় ত্যাগ করার শিক্ষা কোথায় শিখলে?

কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোমা! কিন্তু বৃথায় তোমার তিরস্কার করছি! হেন সহবাসে,

হে পিতৃব্য, বর্বরতা কেন না শিখিবে? যাদের সাথে তুমি বসবাস করছো, হে পিতার সমতুল্য বর্বরতা কেন শিখবে না?

গতি যার নীচ সহ, নীচ সে দুর্মতি।” নিচু মানুষের সাথে যে বসবাস করে, তার মন তো নিচু প্রকৃতিই হবে।

1 comment: